প্রকৃতির রুপে মায়া বাংলা গল্প - Bangla New Romantic Story
গল্প ক্রেডিট
গল্পঃ প্রকৃতির রূপে মায়া।
লেখা - মুহাম্মদ নুরুল আজিম চয়ন।
আমি জানি যে জানালার পাশে আমায় বসতে দিবেন, কথাটা যেইপাশ থেকে আসলো সেদিকে আমার মনোযোগ ছিলো না, হাতে থাকা 'ব্যোমকেশ বক্সী সমগ্র' বইটার পৃষ্ঠা নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত আমি। মেয়েলি কণ্ঠ, তার উপর মেয়েটির অদ্ভুত কথা শুনেই তাকিয়েছি তার দিকে, কথাটা শেষ হয়ে গেলেও মেয়েটির চেহারায় এখনো হাসির আভা লেগে আছে, মুলত কথাটা বলার সময়ই হেসেছিলো সে, যার শীতল শব্দ এখনো কানে বাজছে।
মেয়েটির চেহারার দিকে তাকিয়ে যা বুঝলাম, সে কথা বলতে না চাইলেও আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে জোর করে হলেও তার সাথে কথা বলতে চাইবে, তাও ওদিকে তেমন সাড়া দিলাম না, একপ্রকার বলা যায় তার হাসিমাখা মুখকে এড়িয়ে গেলাম, এর একটা কারণ হচ্ছে, আমার টিকিট অনুযায়ী আমি জানালার পাশের সিটটাতে বসেছি, আমার বামপাশে আরো একটা সিট রয়েছে, হতে পারে এই সিটটা মেয়েটিরই হবে।
আমার তার সাথে কথা না বলার অনাগ্রহটা যখন প্রকাশ করেছি, ভাবছি এতে তার খারাপ লেগেছে, নিজের মধ্যেই কেমন যেন আফসোস লাগতে শুরু করেছে, আমার কিছু একটা বলা উচিত ছিলো, কিন্তু এখন মেয়েটি হয়তো চুপচাপ হয়ে বসে পড়েছে পাশের সিটে, নিজে নিজে আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাসটা আমার কখনোও ছিলো না, কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে নিয়মটা বদলে দেই, তার সাথে আগ বাড়িয়ে কিছু একটা বলি।
বইয়ের পৃষ্ঠা নাড়াচাড়া করতে করতে যখন ফের বামপাশে তাকিয়েছি, তখন দেখলাম মেয়েটা সেই হাসিমাখা মুখ নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে আমার আচরণটা সুন্দর হয়নি এ-ই ভেবে যখন কিছু একটা বলতে চাইলাম, তখন সে ফের বলল, 'কি জনাব! খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দেখি কেস নিয়ে, তা কেউ কি কিছু চুরি করে নিয়ে গেল নাকি।
কথাটা বলেই মেয়েটা আবারো একটা হাসি দিলো, হাসিটা এবার স্বচক্ষে দেখতে পেলাম, অদ্ভুত রকমের মেয়েটার হাসি, পুরো শরীরে যেন এক শীতল হাওয়া বয়ে গেছে, আমতাআমতা করে বললাম, 'না, ইয়ে মানে! বসতে পারেন চাইলে জানালার পাশে।
মেয়েটা ফের হেসে বললো, 'কি মশাই! দেখলেন তো, আমি যা বলেছিলাম তাই সত্যি হয়েছে, তা বললেন না তো?
ফের প্রশ্ন দেখে বসা হতে উঠতে উঠতে বললাম, 'না না, তেমন কোনো ব্যাপার নয়, আসলে..!'
আমাকে থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি ফের বললো, 'ব্যোমকেশ বক্সী আপনার পছন্দের বই তাই তো!'
'জি, একদম।'
মেয়েটি আমার ডানপাশে জানালার পাশেই বসে পড়েছে, আমি আমার সিটে বসেই বইয়ের পৃষ্ঠা আবারো নাড়াচাড়া করছি। তবে এইবার পৃষ্ঠার পাতায় মন বসছে না, এটাই বোধহয় নিয়ম, পাশে কোনো সুন্দরী মেয়ে বসলে বোধহয় বইয়ের পৃষ্ঠা তার দিকে আকৃষ্ট করতে পারে না।
আমার কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলল, 'জানেন! জানালার পাশে না বসলে আমার ভালো লাগে না, গাড়ি চলা অবস্থায় রাস্তার পাশের যে প্রকৃতি দেখি তা আমায় টানে, মনে হয় তাদের সাথে আমার যুগ-যুগ ধরে সম্পর্ক, তারা যেন ডাকে আমায়।
মেয়েটার কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়েছি, প্রকৃতির রূপ বুঝতে পারা মানুষের সাথে আমার কম সাক্ষাৎ হয়েছে, এই মেয়ের চেহারা দেখে মোটেও বুঝার উপায় নেই যে সে প্রকৃতিপ্রেমী।
'এই কারণেই বসতে চেয়েছেন, তাই তো?'
'হ্যাঁ, আচ্ছা আপনি কোথায় যাবেন? দূরে কোথাও?'
'দূরে বলতে, ঢাকায় নামবো। আপনিও কি ঢাকা যাবেন নাকি?'
মেয়েটা আমার কথার প্রতুত্তরে বললো, 'আমার ঠিক নেই, যেখানেই ভালো লাগবে, নেমে পড়বো।'
'ওও আচ্ছা!' বলে আমি কথা থামিয়ে দেই, আর কি কথা বলা যায় তা আমার মাথায় আসছে না, কীভাবে মানুষ অচেনা মানুষের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে পারে? কীভাবে তারা কথার ঝুড়ি বানায় তা আমার মাথায় আসছে না এই মুহূর্তে, এসব যখন ভাবতে ব্যস্ত আমি তখনই সে আমায় অবাক করে দিয়েছে তার এক কথায়।
'আপনার নাম চয়ন, তাই না?'
আমার নাম কীভাবে জানে তা আমার জানা নেই। তবে তার কথায় যে আমি অবাক হয়েছি তা বুঝতে না দিয়েই বললাম, 'নাহ, হয়নি, আমার নাম হচ্ছে মুহাম্মদ নুরুল আজিম চয়ন।
কথাটা শোনা মাত্রই মেয়েটি অদ্ভুতভাবে হাসতে শুরু করে দিয়েছে, এই হাসি তাচ্ছিল্যের কিনা বুঝতে না পারলেও কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছি বেশ, তার অদ্ভুত হাসির দিকে তাকিয়ে বললাম, 'না মানে, পুরো নাম বলতে পারেননি আপনি, তাই!'
'আসলে আপনার পুরো নামটাই জানা। তা আমার নাম জানতে চাইবেন না?'
মেয়েটা এই কথা বলা মাত্রই নিজের ভিতর কেমন যেন আফসোস লাগতে শুরু করেছে। কেন এতক্ষণ তার নাম জিজ্ঞেস করলাম না? এতক্ষণ কথা বলার জন্য কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না, অথচ নাম জিজ্ঞেস করার পয়েন্টটাও মনে ছিলো না।
'দুঃখিত, আমি আসলে..! আচ্ছা আপনার নামটা কী?'
প্রশ্নের প্রতুত্তরে যখন মেয়েটি কিছু বলতে চাইবে ঠিক তখনই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, 'থাক, আমিই গেস করি তো! কি নাম হতে পারে?'
মুখে হাত বসিয়ে ভাবতে ভাবতে বললাম, 'নিশ্চয়ই আপনার নাম হতে পারে 'মায়া'। অর্থাৎ চেহারার সাথে যদি মিলিয়ে কেউ নামকরণ করতে চায় তবে অবশ্যই আপনার নাম মায়া হওয়া উচিত ছিলো।'
আমার এমন কথা শুনে মেয়েটি ফের হাসতে শুরু করেছে। এই হাসি যেন থামার মতো নয়। এইবার তার হাসি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখলাম দুই গালে সামান্য টোল পড়ছে। এই টোল ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে করছিলো বেশ। এমন সুন্দর জিনিস ছুঁয়ে না দেখলে পরে আফসোস করতে হবে।
এই ভাবনা যখন আসে মনের ভিতর, তখন মেয়েটি বলেলো 'উঁহু, এখন ছুঁয়ে দেখার দরকার নেই। একবার ছুঁয়ে দেখলেই তৃষ্ণা মিটে যাবে। তারচে বরং, ছুঁয়ে দেখার প্রবণতা থাকুক, বাড়তে থাকুক, সে-ই ভালো।'
মেয়েটার কথায় ফের অবাক হলাম। মেয়েটি কি আমার মনের কথা সব পড়ে ফেলছে? কীভাবে বুঝতে পারছে সে আমার মনের মধ্যে তাকে নিয়ে কি চলছে? কেমন যেন লজ্জা লাগছে নিজের কাছেই।
মেয়েটা জানালার গ্লাসটা হাল্কা খুলতেই বাতাসের উত্তেজনা অনুভব করছি। গাড়ির গতির কারণে বায়ুর প্রবাহ বেশ, সেই সাথে বাতাসের এই শব্দ, শীতল বায়ু, সবকিছুই যেন শরীরে এপাড় ওপাড় করে দিচ্ছে।
'একটু খোলা থাকুক?'
মেয়েটির প্রশ্নের উত্তরে বললাম, 'বেশ ভালো লাগছে। রাতের বেলা প্রকৃতির দৃশ্যটা উপভোগ করার মতো। তার উপর আবার পূর্ণিমা। ভয়ংকর রকমের সুন্দর প্রকৃতি।'
মেয়েটি জানালার দিকে তাকিয়ে বললো, 'জানেন! আমার মনে হয় প্রকৃতি আমাদের ডাকে, আমরা তার ডাকে সাড়া দেই না৷ এইযে আমরা তাদের এড়িয়ে চলি, এটা ঠিক বলুন? আমাদের কি উচিত না তাদের ডাকে সাড়া দেওয়া? আমাদের কি করণীয় না তাদের সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলা?'
কথার পরে আসে কথা, হরেক রকমের কথা! এমন একটি কথা আমি বলে ফেলছি, জানিনা আদৌও এটা বলা উচিত হয়েছে কি-না!
'আমরা কি চাইলেই প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পারি? এটা তো অসম্ভব একটা ব্যাপার!'
'আপনারা তো গল্পে অনেক কিছুই করেন, পারবেন না আমাকে প্রকৃতির সাথে মিশিয়ে দিতে? আমার না! খুব করে ইচ্ছে হয় প্রকৃতির সাথে মিশে যায়।'
মেয়েটির কথায় এইবার আরও অবাক হলাম। আমার লেখালেখির ব্যাপারেও মেয়েটার ধারণা আছে। এই মেয়েটি কি আমার চেনা-জানা কেউ?
ফের মেয়েটি মুচকি হেঁসে বলল, 'আমরা তো সবাই সবার কাছে চেনা। সবাই তো মানুষ! জানতে আর লাগে কতক্ষণ?' কথাটা বলেই মেয়েটি ফের একটা মুচকি হাসি দিয়েছে।
আর যাই বলি না কেন! মেয়েটার হাসিটা দেখার পরে আর কোনো কিছুই মাথায় থাকে না। কেমন যেন সব গুলিয়ে ফেলছি।
'অনেকদিন যাবদ আপনার লেখার অপেক্ষায় আছি, আপনি এখন লিখেন না কেন? লিখবেন, ভালো ভালো লেখা লিখবেন। প্রকৃতি নিয়ে লিখবেন, মানুষ নিয়ে লিখবেন। আপনি না লিখলে কীভাবে প্রকৃতির মাঝে আমায় হারিয়ে ফেলতে পারবেন?'
মেয়েটাকে হারানোর কথাটা শুনে কেমন যেন বুক কেঁপে উঠলো। কোনো পরিচয় নেই, তাও অদ্ভুত এক মায়ার কাছে যেন নিজেকে আঁটকে ফেলছি।
ইদানীং লিখালিখিটা হচ্ছে না। কেন যেন পারছি না লিখতে, অজানা এক কারণ বশত সব গুলিয়ে ফেলছি।
মেয়েটার চেহারার দিকে তাকাতেই অদ্ভুতভাবে অবাক হলাম। মেয়েটার চেহারার একটা আভা দেখতে পাচ্ছি। সে কিছু একটা যেন পেয়েছে, যার জন্য সে অপেক্ষা করেছিলো যুগ যুগ ধরে।
আমায় বলল, 'নামবো এখানেই, দেখুন প্রকৃতি কি অপরুপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে!'
মেয়েটা নেমে যাবে! ব্যাপারটা কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধকর স্বপ্নের মতো। একবার যদি বলে, 'আমার সাথে প্রকৃতির মাঝে হারাবেন?'
কথাটা মনে মনে বলতে বলতেই মেয়েটি আবারো আমায় অবাক করে দিয়ে বলল, 'কী মশাই! বসে আছেন কেন? যাবেন না আমার সাথে? চলেন আজ হারাবো নিরব এই প্রকৃতির মাঝে।
সমাপ্ত